গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ - গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত থাকা দরকার

প্রিয় পাঠক, আপনি কি গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন? তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনাকে এ বিষয়ে জানতে সাহায্য করবে। এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে আমরা আপনাকে গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ এবং গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত থাকা দরকার এ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব। এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ
এ আর্টিকেলটি পড়লে আরো জানতে পারবেন গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেট এর গুরুত্ব, গর্ভাবস্থায় আয়রন ইনজেকশন, হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবির কবে গেলে করণীয় এবং গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার ক্ষতিকর প্রভাব।

ভূমিকা

একজন মেয়ে যখন গর্ভবতী হয় তখন তার শরীরে অনেকগুলো সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া। এই সমস্যা বেশিরভাগ নারীর মধ্যেই দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের সমস্যা হলে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। এটি একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সমস্যা যা ৫০ ভাগ নারীর মধ্যেই হয়ে থাকে।


এমনকি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রক্ত স্বল্পতার কারণে ২০% নারী মৃত্যুবরণ করে থাকে। সেজন্য আমাদের প্রতিটি মানুষের উচিত বেশি বেশি জনসচেতনতা তৈরি করা এবং রক্তশূন্যতা কি এবং হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সবাইকে অবগত করা। একদম গর্ভবতী নারীর শরীরে ১১ পয়েন্ট এর কম রক্ত থাকলে সেটিকে রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা বলা হয়।

গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ

গর্ভকালীন সময়ে বেশিরভাগ নারীদের রক্তস্বল্পতার সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা কি কারনে দেখা যায় সে বিষয়ে আপনাদের সামনে আলোকপাত করব। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক-
  • গর্ভধারণের কারণে অনেক সময় হিমোগ্লোবিন কমে যায়। এ সময় শরীরের জলীয় উপাদান বেড়ে যায় যার ফলে লোহিত কণিকা কম তৈরি হয়। এ কারণে হিমোগ্লোবিন কমে যায়।
  • গর্ভকালীন সময়ে বেশিভাগ নারীদের বমি হয়। বমি হওয়ার কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
  • আয়রনযুক্ত খাবার কম খাওয়ার কারণে রক্তস্বল্পতা বা হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে।
  • হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে ভূল খাদ্যাভ্যাস। সুষম খাবার না খেয়ে শরীরের জন্য ক্ষতিকর এমন খাবার খেলে রক্ত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সমস্যা গর্ভকালীন সময়ে এই সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। এ সময় যেসব খাবার খাওয়া জরুরী সেসব খাদ্য খাবার অনিচ্ছা তৈরি হয়।
  • ভিটামিন সি যুক্ত খাবার কম খাওয়ার কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে।
  • ভিটামিন বি টুয়েলভ এর অভাবে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।

গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার লক্ষণ

গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা দেখা দিলে কয়েকটি লক্ষণ প্রকাশ পাবে। তাহলে চলুন গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার লক্ষণগুলো জেনে নেওয়া যাক-
  • মাথা ঘোরা
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা
  • বুক ব্যথা
  • হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
  • ক্লান্তি ভাব এবং দুর্বলতা
  • ঠোঁটের কোণে ক্ষত এবং জিহ্ববার ঘা
এ লক্ষণগুলো দেখলে বুঝা যাবে শরীরের রক্তশূন্যতা তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় এগুলো লক্ষণ হালকাভাবে থাকতে পারে এবং পরবর্তীতে তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রক্তস্বল্পতার সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এই সমস্যা দূর করতে হবে।

গর্ভাবস্থায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার

গর্ভবতী মহিলা ও গর্ভের শিশু সুস্থ সুস্থ থাকার জন্য আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া অতিব জরুরি। আয়রন সমৃদ্ধ সময় খাবার খাওয়ার ফলে গর্ভবতী মহিলাদের কিছুটা আয়রনের ঘাটতি পূরণ হয়। তাহলে চলুন কোন কোন খাবারে আয়রন রয়েছে ও সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
  • লাল মাংস বিশেষত গরুর বা খাসির মাংসের মত
  • বিভিন্ন ধরনের ডাল যেমন ছোলা, মাশকলায়, মসুর এবং মুগ ডাল
  • চিনা বাদাম, কাজুবাদাম এবং পেস্তা বাদাম
  • ড্রাই ফ্রুটস যেমন খেজুর কিসমিস আখরট বা শুকনা নারিকেল
  • বিভিন্ন ধরনের মাছ যেমন ট্যাংরা, শিং, কাচকি, মলা, চেলা ইত্যাদি
  • ডিম, দুধ ও পনির
  • বিভিন্ন ধরনের সবজি যেমন আলু, ব্রকলি এবং মাশরুম
  • বিভিন্ন ধরনের শাক যেমন লাল শাক, পালং শাক, সবুজ শাক, সবুজ ডাটা শাক, কচু শাক, মুলা শাক, পালং শাক ইত্যাদি।

গর্ভাবস্থায় আয়রন ট্যাবলেটের গুরুত্ব

গর্ভের শিশুর সঠিক বিকাশ এবং গর্ভবতী মায়ের উচ্চতার জন্য আয়রনের চাহিদা মেটানো খুবই জরুরি। গর্ভকালীন সময়ে আয়রনের চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায় যা আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয় না। সেজন্য আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। আয়রন ট্যাবলেট খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি কমে যায়।

গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কত থাকা দরকার

হিমোগ্লোবিন শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ করতে সাহায্য করে। আমাদের দেহের আয়রনের এক ধরনের প্রোটিনকে হিমোগ্লোবি বলে। শরীরের রক্তের পরিমাণ কমে যাচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য হিমোগ্লোবি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এখানে আমরা গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কত থাকা প্রয়োজন এ সম্পর্কে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।


বিশেষজ্ঞরা বলেন গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সব সময় ১০ এর উপরে থাকা উচিত। ১০ এর কম বা ৮ এর উপরে থাকলে এই হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকে বলা হয় অল্প মাত্রায় রক্তস্বল্পতা। যদি ৮ এর কম হয় বা ৬ এর বেশি হয় তা বেশি মাত্রায় রক্তস্বল্পতা। ৬ এর নিচে নামলে তা মারাত্মক পর্যায়ে রক্তস্বল্পতা এবং এ পর্যায়ে গর্ভবতী নারী এবং গর্ভে থাকা বাচ্চার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়

আমরা আগেই জেনেছি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কেমন থাকা উচিত। এবার চলুন আমাদের আর্টিকেলের মূল আলোচিত বিষয়ে। এটা হল হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়। বিভিন্ন কারণে শরীরের রক্ত নেয়োর প্রয়োজন পড়ে, বিশেষ করে হিমোগ্লোবিন অতিমাত্রায় কমে গেলে। মহিলাদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ এর উপরে থাকলে তা স্বাভাবিক ১১ থাকলে বেশি ভালো।


৮ বা এর নিচে নেমে গেলে তখন শরীরের রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। গর্ভাবস্থায় বা বাচ্চা প্রসবের পরে বিভিন্ন কারণে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে। তখন রক্ত দেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। কারণ এই সময় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক কমে যায়।

গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে গেলে করণীয়

গর্ভকালীন সময়ে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া অন্যতম প্রধান সমস্যা। অবস্থায় মহিলাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান সমস্যা হচ্ছে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে গর্ভবতী মহিলাদের বা গর্ভে থাকা বাচ্চার জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। সেজন্য এই সময় হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের পরিমাণ মাঝে-মধ্যে জানা খুবই জরুরী।

যাদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায় তাদের অবশ্যই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিন খাওয়া প্রয়োজন। তবে আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের মাধ্যমে ঘাটতি অনুযায়ী হিমোগ্লোবি ন পূরণ হয় না। সেজন্যে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট বা প্রয়োজন হলে আয়রন ইনজেকশন গ্রহণ করা উচিত।

আবার গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত হিমোগ্লোবিন কমে গেলে সে ক্ষেত্রে শরীরে রক্ত নেওয়া প্রয়োজন। তবে সব সময় মাথায় রাখতে হবে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কেমন রয়েছে। কারণ হিমোগ্লোবিন কমে গেলে গর্ভে থাকা বাচ্চার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গর্ভাবস্থায় আয়রন ইনজেকশন

একজন গর্ভবতী নারীর শরীরে যে পরিমাণ হিমোগ্লোবিন থাকা দরকার তার চেয়ে কমে গেলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। হালকা করে রক্তশূন্যতা দেখা দিলে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয় আবার অনেক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার এর মাধ্যমে তা পূরণ হয়ে যায়।

কিন্তু অনেক গর্ভবতী মায়ের আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি পায় না বা রক্তশূন্যতা থেকেই যায়। এমনকি রক্ত শূন্যতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। অবস্থা তৈরি হলে তখন প্রয়োজন হয় আয়রন ইনজেকশন দেওয়া বা রক্ত পরিসঞ্চালন করা।

অতএব বেশি রক্তশূন্যতা দেখা দিলে তৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ইনজেকশন প্রদান করা হয়ে থাকে। এই ইনজেকশনের মাধ্যমে রোগী দ্রুত হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি পায় বা রক্তশূন্যতা কমে যায়।

গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকর প্রভাব

গর্ভাবস্থায় অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে রক্তস্বল্পতা বা হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া। রক্তশূন্যতা থাকলে গর্ভবতী মহিলা বা গর্ভে থাকা বাচ্চার যেসব সমস্যা হতে পারে তা নিম্নে আলোচিত হলোঃ
  • শারীরিক দুর্বলতা বৃদ্ধি পায়
  • রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়
  • নির্দিষ্ট সময়ের আগে সন্তান প্রসব হয়
  • প্রসব পরবর্তী সময়ে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়
  • গর্ভকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সংক্রমনের আশঙ্কা
  • দুগ্ধ উৎপাদনে ব্যাহত হওয়া
  • শরীরে পানি আসা

লেখক এর মন্তব্য

গর্ভকালীন সময় মেয়েদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এ সময় নারীদের প্রতি বিশেষ সচেতনতা প্রয়োজন হয়। হিমোগ্লোবিন গর্ভকালীন সময় যে কোন কারণে কমে যেতে পারে। সেজন্য গর্ভকালীন সময়ে অন্তত দুই থেকে তিনবার হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা উচিত। প্রিয় পাঠক, এ আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লাগে এবং উপকৃত হন তাহলে আপনি আপনার বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে শেয়ার করুন৷

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url